SR-71 ব্ল্যাকবোর্ড : বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির যে বিমান। পর্ব (1)
একটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমান সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশে ৮৫ হাজার ফুট উপরে উঠছে। রাস্তায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলতে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির গাড়ির নাম্বার প্লেটের ছবি তুলে নিলেন নিখুঁতভাবে ৮৫ হাজার ফুট উপরে থাকা উড়োজাহাজ থেকে! সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেড শত্রুউড়োজাহাজ অনুপ্রবেশের বিষয়টি টের পেয়ে মিসাইল ছুরতে লাগলেন। সুপারসনিক যুদ্ধবিমান উড়তে লাগল আকাশে। কিন্তু কালো পাখির নাগাল পেল না কেউই। কেননা মিসাইল এর চেয়েও বেশি গতি-সম্পন্ন ছিল সে বিমানের গতি।
পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন যে, এটা কি কখনো আবার সম্ভব না কি? বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমানের গল্প আজ আপনাদেরকে জানানো হবে। চার হাজারের বেশি মিসাইল নিয়ে ধাওয়া করে যে বিমানকে কখনো ধরতে পারেনি তার চব্বিশ বছরের সার্ভিস লাইভে!
স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। তবে এই যুদ্ধটা কোন প্রথাগত যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধে একে অন্যকে মিলিটারি ও টেকনোলজিক্যাল দিক দিয়ে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ছিল মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৬সালে এই যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে, একটি গোয়েন্দা উড়োজাহাজ বানান তার নাম ইউ -২ নামে অভিহিত করা হয় এটি সোভিয়েত আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে ছবি তুলে নিয়ে আসতেন। একটি ইউ-২ উড়োজাহাজ ভূপাতিত হয় হাজার ১৯৬০সালে ৭০হাজার ফুট উপর থেকে ছবি তোলার সময় সোভিয়েত এন্টি এয়ার ক্রাফট মিসাইল হামলা। এই ইউ -২ বিমানের পাইলট কে গ্রেফতার করা হয় এবং দুই দেশের সম্পর্কে ব্যাপক অবনতি হয়।
এর পরেই স্যাটেলাইট ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয় এটি রিকন বিমানের বদলে এবং করোনায় স্পাই স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম ত্বরান্বিত হয়। এই স্যাটেলাইট সংক্রান্ত বিস্তারিত আর্টিকেল আলোচনা করা হয়েছে যে সব সময় গোয়েন্দাগিরি করা সম্ভব হচ্ছিল না করোনা স্যাটেলাইট দিয়ে। তাই গোয়েন্দাগিরি করার জন্য নতুন বিমানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৬৪ সালে এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হয় long-range ,high speed, high-altitude শ্রেণীর রিকনসিস উড়োজাহাজ SR-71।
লকহিড কর্পোরেশন হলো একটি মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এর নাম, Blackbird নামের উড়োজাহাজটি তৈরি করেছেনএই প্রতিষ্টান টি, যার শব্দের গতি ৩.২ গুণ ছিল! জেট ইঞ্জিন এর চেয়ে দ্রুতগতির উড়োজাহাজ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত আরেকটু তৈরি হয়নি ব্দীতীয় বারের মতো। নাসা এর মহাকাশ গবেষণা প্রোগ্রামের ভূমিকা রেখেছিল এস আর-৭১ মার্কিন এয়ারপোর্ট থেকে অবসর নেওয়ার পর। আগেকার দিনে এস আর-৭১ দিয়ে যে কাজটি করতো বর্তমানে ড্রোন দিয়ে সেই কাজটি পরিচালনা করা হয়। SR মূলত strategic Reconnaissance এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
এই অদ্ভুত উড়োজাহাজ টির কনসেপ্ট তৈরি করেন যিনি, তার নাম ইঞ্জিনিয়ার ক্ল্যারেন্স জনসন। ক্ল্যারেন্স জনসন তার টার্গেট ছিল এমন হাইস্পিড ইন্টারসেপ্টর (শত্রু বিমানকে ) ধাওয়া করার মতো উড়োজাহাজ তৈরি করা যে টি কি না ধরা পড়বে না রাডারে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রোটোটাইপ আসে YF-12 তিনটি , এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহন করতে সক্ষম ছিল তিনটি করে। ইন্টারসেপ্টর এর চেয়ে রিকনসিস গোয়েন্দা হিসেবে ভালো কাজ করবে এটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ চাহিদা এবং y12 এর ফিল্ড পারফরমেন্সে দেখা গেল। যার ফলে এই বিমানের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে ১২ এবং A-12 রিকনসিস উড়োজাহাজ বানানোর কাজ শুরু করা হলো।
এই উড়োজাহাজ টি চালনার জন্য একজন পাইলট দরকার ছিল। একটি এ -১২ গোয়েন্দা বিমান ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক মিশনে একসাথে ৬ টি ভিয়েতনামিজ surface-to-air মিসাইলস ফাঁকি দিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। পাইলটের ঝুঁকি কমাতে মার্কিনরা ডি -২১ (১০২ ফিট লম্বা )একটি সুপার সনিক ড্রোন তৈরি করে যা মূলত বামন ভার্সন। এই বিমান ঘন্টায় ৩,৬০০ কিলোমিটার বেগে ৯০ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে ছবি তোলার কাজ শেষ করে নিজে নিজে ধ্বংস হয়ে যেত এই ড্রোন উড়োজাহাজ! এ ১২ এর দুজন পাইলট চালিত ভার্সন এম টষ-২১ বানানো হয় ড্রোন বহন করার জন্য।
এই ড্রোনগুলো একবারের বেশি ব্যবহার করা সম্ভব হয়না দ্বিতীয়বারের মতো তাই এই ড্রোনগুলো ব্যবহারের খরচের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পরে এসে আর-৭১নামের সম্পূর্ণ একটি নতুন বিমানে প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয় যাতে খরচ এর মাত্রা ড্রোন বিমানের চেয়ে কম হয় এবং প্রতিবার ব্যবহার করা সম্ভব বেশি হয়। এসব কথাগুলো বলার অর্থ হচ্ছে একটা মানে যে এফ-২১,এ-১২ এগুলো সবই এস আর-৭১জা খালি চোখে দেখলে এমন মনে হয়। কোন প্রকার মিসাইল বা অন্য কোনো অস্ত্র ছিল না একমাত্র y-১২ উড়োজাহাজ বাদে ঐ সময়ে।
সাড়ে তিন হাজার পাউন্ড ওজনের ক্যামেরা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক মালামাল বহন করত এস আর-৭১ বিমান। এটি খুবই এ নিখুঁত ভাবে ছবি তুলতে পারত বিধায় ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ,সোভিয়েত ইউনিয়ন ,গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা যেত এই বিমান কে। ১,০০০ বর্গমাইল এলাকা সার্ভে করতে পারতো এই বিমানটি মাত্র ১ ঘন্টায়। সবশেষে বলা যায় যে ,এত আধুনিক মানের ক্যামেরা ছিল ব্ল্যাক বার্ড এর যে রাস্তায় ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে থাকা গাড়ির নাম্বার প্লেটের ছবি ৮৫ হাজার ফুট উপর থেকে নিখুঁতভাবে খুব সুন্দর করে তোলা যেত এই উড়োজাহাজ থেকে।
জিপিএস প্রযুক্তি ছিল না সে সময়ের যুগে। কম্পাস ভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেম ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতায় পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কারণে ভুলে রিডিং দেয়। তাই আকাশের তারা দেখে পথ চলতো ব্ল্যাকবার্ড। এটা আসলে অবাক হওয়ারই কথা। অ্যাস্ট্রো ইনারর্শিয়া নেভিগেশন সিস্টেমে এস আর -৭১ব্যবহার করা হয়েছে। ব্লু লাইট নামক এক ধরনের স্টার ট্রাক এই সিস্টেমে ব্যবহার করা হয়েছিল, যা কিনা আকাশের ৬১ টি তারার অবস্থানের সাপেক্ষে বিমানের অবস্থান নির্ণয় করে সঠিকভাবে উড়োজাহাজ চালাতে সহায়তা করত প্রত্যেকটা সেক্টরকে। ব্লাগবাডের একজন সাবেক পাইলট বলেছেন যে, কখনো ভুল করে এই কোর্স থেকে বড়জোড় ৩০০ মিটার ডানে-বামে সরে যেত এই সিস্টেম প্রযুক্তিএতটা উন্নত এবং এতটা সুন্দর ভাবে পরিচালনা করা হতো।
এসা আর ৭১ এয়ারফ্রেম হলো টাইটেনিয়াম এর মত প্রায় ৮৫ পারছেন এর মতো। ফলেএটি তৈরি করার সময় প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তৎকালীন সময়ে এই মূল্যবান ধাতুর প্রধান রপ্তানি কারক ছিল। একটি গোপনীয় প্রজেক্ট এর নাম হলো ব্ল্যাকবার্ড। কেজিবি হলো সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রচুর পরিমাণে টাইটেনিয়াম কিনতে গেলে কেজবি নামক এই সংস্থাটি সন্দেহ করবে। দেশ-বিদেশে বেশ কিছু ভুয়া কোম্পানি তৈরি করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এমন কিছু মূল্যবান ধাতু ক্সয় করে এমন উড়োজাহাজ তৈরি করে যা সোভিয়েত ইউনিয়নের উপরে গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার করা হতো। এই উড়োজাহাজটি উচ্চ গতির কারণে বিমানটি বাতাসের সাথে ঘর্ষণের ফলে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হতো যার দৈর্ঘ্য কয়েক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিত এবং এই তাপ ছিল প্রায়(৩১৬) ডিগ্ৰি।