উসমানীয় যুগের পাখির বাসা
প্রায় ৬,০০০ হাজার বছরের তুরস্কের উসমানীয় যুগের বিস্তৃতি। নানা বিক উন্নত হয়েছিল এই রাষ্ট্র ওই সময়ে। আজও মানুষের কাছে সৌন্দর্যের একটা প্রতীক হলো রাজপ্রসাদ এবং দালানকোঠা। উসমানীয় উন্নতচরিত্র ছিলেন নৈতিকতাও । সৃষ্টির সেবাকে দায়িত্ব মনে করতেন কারণ শ্রেষ্ঠার আনুগত্য হওয়ায়। সেই বোধ থেকে তারা নানারকম প্রশংসনীয় কর্ম করেছেন। পাখির বাসা এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
পাখির প্রতি মমতা বোধ থেকে তারা নিজেদের মাদ্রাসা ,বিদ্যালয়, মসজিদ, বাড়ি ,অফিস ,কফি হাউজ, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা উপাসনালয়ের দেয়ালে কৃত্রিমভাবে সুদূর পাখির বাসা বানিয়ে রেখেছেন। তাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল পাখিরা যেন নিরাপদে বসবাস করতে পারে ডিম পারতে পাড়ে বাচ্চা লালন পালন করতে পারে এতে যাতে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়। শুধু তাই নয় প্রাচীনকাল থেকে তুর্কিরা সৃষ্টি সেবার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।
শুধু তাই নয় তুরস্কের জনগণ পাখিদের এতটাই ভালবাসতেন যে তারা পাখিদের বাসায় প্রয়োজনীয় খাবার এবং পানি রেখে আসতেন এবং তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেন। বর্তমানে তুর্কি জনগণ আজও প্রাচীনকালের তুর্কিদের নিয়ম-নীতি মেনে চলেন। আপনি যদি তুর্কি শহরের রাস্তায় বা অলিতে-গলিতে হাঁটেন তাহলে সেখানে গাছপালায় দেখতে পাবেন পাখিদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা আছে। স্রষ্টার জন্যই সৃষ্টিকে ভালবাসি আমরা এ কথাটি বলেছেন উসমানীয় সুফি কবি ইউনুস এমরের। এই কোবির মতে পশুপাখিদের প্রতি ভালোবাসা মমতা ও যত্ন করার জন্য আনাতোলিয়ানদের সৃষ্টি করা হয়েছে।
বহু আগে থেকেই উসমানীয় যুগের পশু পাখির যত্ন ও সুরক্ষার জন্য প্রচলিত প্রাণী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষ আইনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। পৃথিবীতে নবশিল্পের সূচনা করেছেন প্রাকৃতিক ভাবে সংবেদনশীল ছোট্ট পাখি গুলোর প্রতি তাদের দয়া মায়ার জন্য। পাখির নিরাপত্তার জন্য তৈরি করেছেন তারা দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত সুন্দর পাখির বাসা যেখানে পাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারবে এবং ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করতে পারবে। বয়সের ভারে আজ অনেক পাখির বাসায় আছে যেগুলো নষ্ট ভেঙে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু সেগুলো পূর্ণ সংস্কারের জন্য আবার কাজ করা হচ্ছে।
কুসুরুত তয়ুর এবং মানাঝিলল আসাফির নামে ডাকে কৃত্রিম উপায়ে নির্মিত এসব বানানো পাখির বাসাকে তুর্কিরা আরবিতে। উসমানীয় যুগে পাখির বাসা বানানো কাজ শুরু করা হয় ষোড়শ শতাব্দীতে ।উসমানীয় যুগে পাখির বাসা তৈরীর জন্য শিল্প পূর্ণতা পায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আর তারপর থেকেই সেখানে তুরস্কের বাসিন্দাদের বাড়ির দেয়ালে ,মসজিদের দেয়ালে ,এমনকি রাস্তা ঘাটের পাশে গাছপালায় পাখির বাসা তৈরি করা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। তবে একটা দুঃখের কথা হল এই যে কাঠের তৈরি বাসাগুলো এখন আর নেই সেগুলো ধসে পড়েছে।
ইস্তাম্বুলের বালি পাসা মসজিদের দেয়ালের বাসা বিশেষভাবে পরিচিত উসমানী আমলে প্রাচীন বাসাগুলোর মধ্যে, এই বাসাগুলো স্থাপন করা হয় ১৫০৪ সালে। শহরের সায়েদ হাসান পাশা মাদ্রাসার দেয়ালের বাসাগুলো একই সময়ে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। একই সঙ্গে প্রাচীনতার দিক থেকে সুলতান তৃতীয় মোস্তফার সমাধি এশীয় অঞ্চলে প্রাচীন দুটি মসজিদ, প্রাসাদ ,ঐতিহাসিক তাকসিম স্কয়ার মসজিদ, এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের একাধিক উপাসনালয়ের দেয়ালে দৃশ্যমান বাসাগুলো উল্লেখের দাবি রাখে।
স্থাপত্য শিল্পির বিষয় বিবেচনা করা হয়নি ইট-পাথরের নির্মিত এসব বাসায়। বরং এই বাসাগুলো নির্মাণে আরো সূক্ষ্ম বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাসাবাড়ি বা ভবনের উঁচু স্থানে পাখির বাসা তৈরি করা হতো যাতে কোনো হিংস্র প্রাণী পাখির বাসা নষ্ট না করতে পারে এবং কোন পাখিকে ক্ষতি করতে না পারে। একইভাবে রোদ বৃষ্টি যেন পাখির বাসার কোন রকম ক্ষতি করতে না পারে সে রকম ব্যবস্থা করা হতো।
ইট-পাথরের পাখির বাসা একটি স্বতন্ত্র শিল্পে পরিণত হয় গোটা উসমানীয় শাসনকালে। সুন্দর ভবন তৈরি করতে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো ঠিক পাখির বাসা তৈরি করতেও ঠএকই রকম গুরুত্ব দেওয়া হতো। তৎকালীন স্থপতি ও প্রকৌশলীগণ তুলনামূলক সুন্দর ও আকর্ষণীয় পাখির বাসা নির্মাণে পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন এবং বাসা তৈরি স্থাপত্য সংস্কৃতিতে যার যার সেরা দক্ষতা উপস্থাপন করতেন তারা।
উসমানীয়দের অনন্য নির্দেশন গোটা সাম্রাজ্য ব্যাপী বিস্তৃত থাকলেও পাখির বাসা নির্মাণের জন্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত ছিল ইস্তাম্বুলে। শুধু তাই নয় ,পশ্চিমা দেশগুলোর গগনচুম্বী অট্টালিকা ও ঐতিহাসিক স্থাপনা সমূহের দেয়ালেও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে কৃত্রিমভাবে তৈরি পাখির বাসা। ইস্তাম্বুল জার্নিতে পশুপাখির প্রতি উসমানীয় তুর্কিদের বিশেষ মমতার কথা জানিয়েছেন ইতালীয় লেখক এডমুন্ডো ডি আরিজি ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থে। প্রচন্ড ভালোবাসা এবং সহানুভূতির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি ।স্মৃতিচারণা করে তিনি লিখেছেন যে,
তুর্কিদের কি উষ্ণ সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা অগণিত প্রজাতির পাখি গুলোর প্রতি, পুরাতন ভবন ,উদ্যান ,মসজিদ ,যেখানে যাবেন শুধু দেখতে পাবেন পাখি আর পাখি। আপনার মনকে অবশ্যই আন্দোলিত করে তুলবে সেই পাখিগুলো কিচিরমিচির ডাক আর ডানা ঝাঁকুনির শব্দ।
তুর্কীয় পাখিদের পারস্পারিক সম্পর্কে আরও লিখেছেন এডমুন্ডো আরিজি, তুর্কির প্রতিটি মানুষের মাঝে পাখিদের ভালোবাসা বিরাজ করে কেননা সব সভ্যতাবোদে একটি একটি পাখি সূক্ষ্ম অর্থবহ ভিন্ন দিক ইঙ্গিত করে। হজের মৌসুমে মক্কায় আবাবিল পাখি এবং মানিকজোড় পাখি নিরাপত্তার’ প্রতীক হয় । প্রেমের প্রতীক হলো কবুতর। এইজন্য তুর্কির মানুষ সারা বছর ধরে পাখিদের সুরক্ষা করে যত্ন করেন এবং পাখিদেরকে খাওয়ানোর জন্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হন।
রাষ্ট্রের তরফ থেকে পাখি চিকিৎসার জন্য দাওয়াখানা তৈরি করা হয়েছিল ।পাখিদের প্রতি উসমানীয়দের এতোটা ভালোবাসা ছিল কারন এইসব প্রজাতি সবকিছু স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। কোন পাখি অসুস্থ হলে তা সুস্বাস্থ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হতো। কয়েক শতাব্দি কেটে গেলেও তুর্কিরা পাখিদের ভালোবাসা আজও করে যাচ্ছেন। বিগত বছর তুর্কির রাজা ৬ লক্ষ ৭০,০০০ কৃত্রিম পাখির বাসা স্থাপন করেছেন রাস্তায় ,গলি ,পার্কে ,উদ্যানে ,এমনকি বিভিন্ন দেয়ালে। এই ব্যবস্থা শুধু পাখিদেরই নিশ্চিত করছে না বরং বন-বনানী ,গাছপালা ক্ষতিকর পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ থেকেও রেহাই পাচ্ছে।